গাড়ি থাকলে সাবধান, E20 পেট্রোল ব্যবহারে হতে পারে বড় ক্ষতি! বিপদে পড়ার আগেই জেনে নিন

ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোল নিয়ে বহুদিন ধরেই ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে গাড়ি ব্যবহারকারীদের মধ্যে। বর্তমানে ২০ শতাংশ ইথানল যুক্ত পেট্রোল ব্যবহার করা হচ্ছে, এই পেট্রোলকে E20 পেট্রোল

Antara Nag

e20 petrol

ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোল নিয়ে বহুদিন ধরেই ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে গাড়ি ব্যবহারকারীদের মধ্যে। বর্তমানে ২০ শতাংশ ইথানল যুক্ত পেট্রোল ব্যবহার করা হচ্ছে, এই পেট্রোলকে E20 পেট্রোল (E20 Petrol) বলা হয়। অভিযোগ উঠছে যে, এই পেট্রোল ব্যবহার করায় গাড়ির যন্ত্রাংশের ক্ষতি হচ্ছে এবং গাড়ির পারফর্মেন্স কমে যাচ্ছে। সম্প্রতি এ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন আইনজীবী অক্ষয় মলহোত্রা। কিন্তু সেই মামলা খারিজ করে দেন সুপ্রিম কোর্টের দেশের প্রধান বিচারপতি বিআর গাভাই ও বিচারপতি কে বিনোদ চন্দ্রনের ডিভিশন বেঞ্চ। অর্থাৎ দেশের সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে বিরোধী দলগুলো যতই বিরোধিতা করুক না কেন দেশের সুপ্রিম কোর্টও E20 পেট্রোল ব্যবহারের পক্ষেই রায় দিল।

E20 Petrol কি? 

ইথানল একটি বায়ো ফুয়েল। ইথানল দহনে পেট্রোলিয়ামজাত তেলের দহনের তুলনায় পরিবেশে কম পরিমাণে দূষণ সৃষ্টি হয়। পরিবেশে কম পরিমাণে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড এবং সালফারডাই-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন ঘটায় ইথানল। ইথানল সাধারণত তৈরি হয় আখ, ভাত, জোয়ার, বাজরা, ভুট্টা এবং বেশ কিছু কৃষি জাত বর্জ্য পদার্থ ইত্যাদি পঁচিয়ে। বর্তমানে দেশে ৮০ শতাংশ পেট্রলের সঙ্গে ২০ শতাংশ ইথানল মিশিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রল (EBP), যার নাম E20 পেট্রোল।

ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোল প্রকল্প

২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী রাম নায়েক প্রথমবারের মতো ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোল প্রকল্প চালু করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল দেশে ক্ষতিকর গ্রিন হাউজ গ্যাস, কার্বন ডাই-অক্সাইড ও কার্বন মনো-অক্সাইডের মতো দূষিত বাতাস নির্গমন কমানো। প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সাল থেকেই দেশে ১.৫ শতাংশ ইথানলযুক্ত পেট্রোল বিক্রি আরম্ভ হয়। সরকার সেই সময় লক্ষ্যমাত্রা নেয় ২০৩০ সালের মধ্যেই দেশে ২০ শতাংশ ইথানলযুক্ত পেট্রোল বিক্রি করবে। তবে ২০২৫ সালে এসেই সেই লক্ষ্যমাত্রা পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় সরকার এখন দেশে E30 বা ৩০ শতাংশ ইথানলযুক্ত পেট্রোল বিক্রির চিন্তাভাবনা করছে।

সমস্যা কোথায়?

ব্যবহারকারীদের বক্তব্য হল E20 পেট্রোল দেশের অধিকাংশ গাড়ির জন্যই উপযুক্ত নয়। বিশেষ করে যে সমস্ত গাড়ি ২০২৩ সালের আগে তৈরি হয়েছে সেই সমস্ত গাড়ির পারফরম্যান্স কমাচ্ছে এই ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোল। বলা হচ্ছে এই পেট্রোল ব্যবহারে গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশের ক্ষতি হচ্ছে, গাড়ির গতি কমে যাচ্ছে, গাড়ি ঠিক সময়ে স্টার্ট নিচ্ছে না, গাড়ির ফুয়েল ট্যাংকে রাস্ট পড়ে যাচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

পেট্রলের সাথে জল না মিশলেও ইথানলের সঙ্গে জল খুব সহজেই মিশে যায়। তাই মাটির তলায় রাখা পেট্রোল পাম্পের ট্যাংক গুলি যদি জলের তলায় চলে যায় তাহলে সেখানে ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোলের সঙ্গে খুব সহজেই জল মিশে যায়। পেট্রোলে ইথানল মিশে থাকার কারণে তখন সেই জলকে আর পেট্রোল এর থেকে আলাদা করা যায় না। ফলে জল মিশ্রিত পেট্রোলই ব্যবহারকারীর জ্বালানির ট্যাঙ্কে প্রবেশ করে এবং গাড়ির পারফরমেন্সের ক্ষতি করে।

যার ফলে বিমা কোম্পানিগুলিও দায় নিতে চাইছে না। এছাড়াও আরো একটি বক্তব্য সামনে উঠে আসছে যে, ইথানলের দাম পেট্রোলের থেকে কম হওয়া সত্বেও ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোল দেশের মানুষকে পেট্রোলের দাম এই কিনতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে দাম কেন কমানো হচ্ছে না? এই সমস্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়েই প্রবীন আইনজীবী সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন।

জনস্বার্থ মামলায় আদালতের রায়

সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে কথা বলেন অ্যাটর্নি জেনারেল আর ভেঙ্কটরামনি। তিনি ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোল বিক্রির বিষয়ে সরকারের মনোভাবের ইতিবাচক দিকগুলি তুলে ধরেন ৷ তিনি জানান, ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রল বিক্রি করায় দেশের কৃষকরাও উপকৃত হচ্ছে। EBP পেট্রোলের তুলনায় কম দূষণ ছড়ায়, তাই দেশের পরিবেশের উপরেও ইতিবাচক প্রভাব রাখছে এই জ্বালানি। পরিবেশ ছাড়াও দেশের আর্থিক বিষয়েও এই পেট্রোল ইতিবাচক ভুমিকা নিচ্ছে।

তাছাড়া তিনি আরো বলেন ইউরোপ ব্রাজিল আমেরিকার মতো দেশগুলি আরও কয়েক দশক আগে থেকেই এই ধরনের ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোল ব্যবহার করে আসছে। ওই সব দেশ গুলিতে এখন আর পরিশোধিত পেট্রোল বিক্রি হয় না। আবার অন্যদিকে ভারতে যে সমস্ত গাড়ির কোম্পানিগুলি গাড়ি বিক্রি করে ওইসব দেশগুলোতেও একই কোম্পানি গাড়ি বিক্রি করে। কিন্তু গাড়ির পারফরম্যান্স নিয়ে কোন অসুবিধার কথা ওই সব দেশ থেকে শোনা যায়নি। তাই ভারতেও ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোল নিয়ে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

আইনজীবীর আবেদন

আইনজীবী অক্ষয়ের আবেদন ছিল, তিনি ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোল বিক্রির বিরুদ্ধে নন। কিন্তু দেশের অধিকাংশ নাগরিকই না জেনে E20 পেট্রোল ব্যবহার করছেন। কিন্তু বর্তমানে দেশের সমস্ত পেট্রোল পাম্পে E20 পেট্রোল বিক্রি বাধ্যতামূলক হওয়ায় পরিশোধিত পেট্রোল ব্যবহারের সুযোগ আর নেই। অন্যদিকে এই পেট্রোল ব্যবহারে ব্যবহারকারীদের ক্ষতি হচ্ছে, তাই সরকারের উচিত এই পেট্রোল ব্যবহারের ক্ষতিকারক দিক এবং অন্যান্য বিষয় সংক্রান্ত সমস্ত কিছু জানিয়ে প্রত্যেক পেট্রোল পাম্পেই একটি নোটিশ বোর্ড দিক।

সরকার কেন জোর দিচ্ছে?

জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারে ভারত পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয়। ভারত তার প্রয়োজনের ৮৫ শতাংশ তেলই বাইরে থেকে আমদানি করে। তাই প্রয়োজনের ২০ শতাংশ যদি ইথানল ব্যবহার করা যায়, তাহলে একটা বিরাট পরিমাণ অর্থ বাঁচানো সম্ভব হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী গত আর্থিক বছরে ১.২৫ লক্ষ কোটি টাকা বাঁচানো সম্ভব হয়েছে ইথানল ব্লেন্ডেড পেট্রোল ব্যবহার করে। যার থেকে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা গিয়েছে দেশীয় কৃষকদের হাতে যারা ইথানল তৈরির কাঁচামাল সরবরাহ করে থাকেন। ফলে পরিবেশ বান্ধব হওয়ার পাশাপাশি দেশের আর্থিক খাতেও E20 পেট্রোল একটি বিরাট ভূমিকা রাখছে।

তাহলে উপায়?

যেহেতু সুপ্রিম কোর্ট ইথালন ব্লেন্ডেড পেট্রোল ব্যবহার করা নিয়ে জনস্বার্থ মামলাটি খারিজ করে দিয়েছে, তাই আপাতত আর কোন মুক্তির রাস্তা নেই। মানুষকে বাধ্য হয়েই E20 পেট্রোল কিনতে হবে। তবে কেন্দ্র সরকার আশ্বাস দিয়েছে গাড়ির পারফর্মেন্স ক্ষতির বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে দেখছে এবং এই নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। জানানো হয়েছে ২০৭০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষ কার্বন শুন্য দেশে পরিণত হতে চাইছে। তাই E20 পেট্রোলের জায়গায় বর্তমানে সরকার E30 পেট্রোলের দিকে এগোনোর কথা ভাবছে।

অন্যদিকে সাধারণ মানুষকে গাড়ি কেনার সময় মাথায় রাখতে হবে তার গাড়ির ইঞ্জিনটি E20 পেট্রোলের জন্য উপযোগী কিনা? এছাড়াও গাড়ি মাঝে মাঝে সার্ভিস করাতে হবে এবং গাড়ির পারফরম্যান্স ডাউন হলো কিনা সে বিষয়টি নজরে রাখতে হবে। দরকারে মেকানিকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ভারত দ্রুত পরিবর্তনশীল আর্থিক অবস্থার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে তাই দেশের মানুষকেও নিজেদের পরিবর্তনশীলতার মধ্যে দিয়েই নিয়ে যেতে হবে।