ব্যান্ডেল (Bandel), পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলী জেলার চুঁচুড়া মহকুমার অন্তর্গত হুগলী চুঁচুড়া পৌরসভার একটি এলাকা। ব্যান্ডেল, নামটি “বান্দার” শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ “বন্দর”। আজ আমরা জেনে নেব ব্যান্ডেলের এই “ভেল ভেল” উৎসব (Bandel Vel Vel Festival) সম্পর্কে….।
কি এই “ভেল ভেল” উৎসব ? (Vel Vel festival)
“ভেল ভেল” হল একটি তামিল জনগোষ্ঠীর বাৎসরিক উৎসব। প্রাচীনকালে ভেল তামিলদের রাজরাজাদের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র বর্শা কিংবা শূলকে বলা হত। হুগলি জেলার ইতিহাসে এই মেলা শতাব্দী প্রাচীন। ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি মেনে প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তির আগে (এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এই “ভেল ভেল” উৎসব পালন করা হয় । মূলত তামিল জনগোষ্ঠীর মানুষই এই অভিনব “ভেল ভেল” উৎসবের সঙ্গে জড়িত থাকেন ।
এখানে ব্যান্ডেলে, হুগলির ভক্তরা পবিত্র অনুগ্রহ অর্জনের জন্য ভগবান শ্রী মুথু মারিয়ামমা বা মাতা ওলাইচন্ডী বা মা শীতলাকে আনুষ্ঠানিক বলিদান এবং অর্ঘ্য অভ্যাস করেন । ব্যান্ডেলের ওলাইচণ্ডী মন্দিরে সকাল থেকে চলে ভক্তদের জনসমাগম । এই স্থানীয় এলাকার প্রতিটি কোণ থেকে মানুষ একটি মিছিল দল গঠন করে ওলাইচন্ডিতলায়, তাদের নিজস্ব শৈলীতে সজ্জিত রথ নিয়ে তাদের দেবতাকে নিয়ে জড়ো হয়। বেলার বাড়ার সঙ্গে বাড়তে থাকে ভিড়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে যেমন চড়ক বা গাজন উৎসব হয় অনেকটা সেই ধাঁচেই এই উৎসব।
বান্ডেলের ভেল ভেল উৎসবের ইতিহাস ও কাহিনী (Bandel Vel Vel Festival Historical Story)
হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে পার্বতী তার পুত্র মুুরুগানকে (কার্তিক) একটি ভেল (শূল জাতীয় অস্ত্র) দান করেছিলেন, যার দ্বারা দুষ্ট আত্মা সুরপদ্যমানকে পরাজিত করতে পারে। মুরুগান ও সুরপদ্যমান এর যুদ্ধে মুরুগান সুরপদ্যমানের সমস্ত মন্দ বাহিনীকে চূর্ণ করার জন্য ভেল ব্যবহার করেছিলেন। ভেল উৎসব মূলত শ্রীলঙ্কায় প্রচলিত তবে এই উৎসব দক্ষিণ ভারতের তামিনাড়ুতেও বিশেষ ভাবে দর্শনীয়। এই উৎসব এক মাদ্রাজি রীতি বিশেষ। মুুরুগানকে উৎসর্গ করা মন্দিরগুলিতে এই উৎসব বিশেষ ভাবে পালিত হতে দেখা যায়।
তামিল জনগোষ্ঠীর অনেকেই হুগলি জেলার ব্যান্ডেলে রয়েছেন , তারাই বহু বছর আগে বাংলাতেও শুরু করেন “ভেল ভেল” । এই ভেল উৎসবে প্রতিটি দলে প্রায় এক বা একাধিক লোক থাকে যারা মূল ভক্ত হিসাবে কাজ করেন। প্রথমে তারা ওলাইচণ্ডী তলার একটি পুকুরে স্নান করে এর পর ভক্তদের ওপর দেবতা বা ইত্যাদির অধিষ্ঠান হয়, যাকে বলা হয় ‘ভর’ ।
এরপর তাঁদের নিয়ে আসা হয় ওলাইচণ্ডী মন্দিরে।
ওলাইচন্ডীমাতা মন্দিরে আশীর্বাদ গ্রহণকারী প্রধান ভক্ত অন্যান্য দলের সদস্যদের সহায়তায় বলিদান ও শোভাযাত্রার জন্য প্রস্তুত হন। তারা মুখ দিয়ে বর্শা বিদ্ধ করে এবং উভয় প্রান্তে ত্রিশূল আকারে সংযুক্ত করে, শুধু তাই নয়, তারা তাদের পিঠের মাংসের সাথে হুক করে এবং রথের দড়ি যেখানে তাদের দেবতা রয়েছে সেখানে সংযুক্ত করে এবং রথকে টানতে থাকে। এলাকা পরিক্রমা করে সেই রথ। প্রচলিত গাজন উৎসবের মত এখানেও ভক্তরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ইষ্ট দেবতাকে তৃপ্ত করার চেষ্টা করেন।
সমস্ত আচার-অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে, শোভাযাত্রা দল ওলাইচন্ডী তালা ত্যাগ করে এবং তীর্থযাত্রার পথ দিয়ে বালিকাটা শীতলা মন্দির নামে আরেকটি মন্দিরের দিকে যাত্রা করে যা দূরত্ব 3 কিলোমিটারেরও বেশি। এছাড়াও সারা রাস্তা চিৎকার করতে থাকে ‘ভেল ভেল… ভেল ভেল…. ভেল ভেল …..’
ছবি সৌজন্যে : Anirban Dey ও Smaran Das
তথ্যসূত্রঃ হুগলি জেলার ইতিহাস বই এবং নিবন্ধ থেকে সংগৃহীত কিছু তথ্য।